ভালোবাসায় সিক্ত চুনতির গাছগাছালি-পাখপাখালি

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম চুনতি। গ্রামবাসীর সাহসী প্রয়াসে ধ্বংসের হাত থেকে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে চুনতির বনাঞ্চল। নিরাপদ এখন চুনতির গাছগাছালি, পাখপাখালি। আর গ্রামবাসীর ওই অসামান্য সংগ্রামের স্বীকৃতি মিলল ২০ জুন ব্রাজিলের রিও শহরের বিশ্বধরিত্রী সম্মেলনে। চুনতি গ্রামের মানুষের এই অর্জনকে সম্মানিত করা হয়েছে জাতিসংঘের ইকুয়েটর পুরস্কার দিয়ে। চুনতি গ্রামের মানুষের সেই সাফল্যগাথা শোনাচ্ছেন ইফতেখার মাহমুদ

গাছগুলো গ্রামটির মতোই শত বছরের পুরোনো। বিশাল আকৃতির গর্জন মাতৃগাছগুলো চুনতি গ্রামের মানুষের কাছে মায়ের মতো। বুনো এশীয় হাতির যখন মা হওয়ার সময় হয়, তখন তারা এই মাতৃগাছের বিশাল ছায়ার নিচে এসে আশ্রয় নেয়।
শুধু আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের হাতির দলই নয়, আসে মিয়ানমার ও ভারতের হাতিও। ওরাও আঁতুড়ঘর হিসেবে বেছে নেয় চুনতি বনকেই। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামের মানুষও পরম ভালোবাসায় ওই বুনো হাতির নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য প্রহরা বসায়। এসব গল্প শুনছিলাম চুনতির আনোয়ার কামালের কাছ থেকে। হাতির দল, চুনতির মাতৃগর্জনের বনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আনোয়ার কামালের চোখ ঝলমল করছিল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুই পাশের সেই ঘন বনটি তাঁদের বড় প্রিয়। চুনতি বনে আমি আগেও একাধিকবার গিয়েছি। প্রকৃতিপ্রেমী ওই গ্রামের অনেকের সঙ্গেই আমার সখ্য। তবে আনোয়ার কামালের সঙ্গে আবারও দেখা ও কথা হলো আমাজান বনের দেশ ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে। আনোয়ার কামালের ব্রাজিলে আগমন এক বড় সাফল্যের হাত ধরে। তাঁর জন্মভূমি চুনতি গ্রাম আর চুনতি গ্রামবাসীর বন সংরক্ষণের উদ্যোগী ও সৃজনশীল অবদানের জন্য জাতিসংঘ তাঁর গ্রামের মানুষকে সম্মানিত করেছে এ বছরের ইকুয়েটর পুরস্কার দিয়ে। আনোয়ার চুনতি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য সহব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি। পুরো গ্রামের একজন হয়েই এই পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আনোয়ারের রিও শহরে আসা।

বিশ্বের ৬৬টি দেশের ৮১২টি প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সহব্যবস্থাপনা কমিটির মধ্যে ২৫টি কমিটিকে এবার এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। চুনতি সহব্যবস্থাপনা কমিটিকে কেন পুরস্কার দেওয়া হলো, সে সম্পর্কে ইকুয়েটর পুরস্কারবিষয়ক আয়োজক সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে প্রায় ধ্বংস হতে বসা বনের পুনর্জীবন ঘটেছে চুনতিতে। বনে বন্য প্রাণী ফিরে আসতে শুরু করেছে।

জাতিসংঘের এই পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকেই চুনতি আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনায় ঢুকে পড়েছিল। গত বছর মার্কিন কেব্ল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন) চুনতি বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গঠিত স্বেচ্ছাসেবক নারী বাহিনী নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর বিশ্বের প্রায় শতাধিক সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়। বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষকবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নজরে আসে এই গ্রামের মানুষেরা। আর ইকুয়েটর পুরস্কারকে তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে বর্ণনা করে আনোয়ার কামাল বলেন, ‘বনটি আমাদের গ্রামের মানুষের মতোই আপন। যারা গর্জন মাতৃগাছ চুরি করে নিয়ে যেতে চায়, হাতির দাঁত যাদের কাছে বিকিকিনির বিষয়, আমরা তাদের শত্রু ঘোষণা করেছি। চুনতি বনে তাদের আমরা ঢুকতে দিই না। ভয়ংকর শিকারি থেকে শুরু করে কাঠ পাচারকারী— সবাইকে আমরা মোকাবিলা করি আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই। বন রক্ষায় চুনতি গ্রামের মানুষের একতার শক্তি আর বনের গাছগাছালি ও প্রাণীর প্রতি ভালোবাসাই আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। জাতিসংঘের এই পুরস্কার আমাদের সেই ভালোবাসারই স্বীকৃতি। এখন আমাদের পরিকল্পনা, পুরস্কারের সব টাকা ব্যয় হবে আমাদের চুনতি বন আর তার বাসিন্দা বন্য প্রাণীর সুরক্ষায়।’

শুরুটা শিকারিদের নিয়ে
চুনতি গ্রামের মানুষের বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রাম ও সাফল্যগাথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্থান করে নিলেও চুনতি গ্রামের মানুষের জন্য ওই লড়াইয়ের শুরুটা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। ২০০৫ সালের কথা। নির্বিচারে গাছ কেটে নেওয়ায় গ্রামের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি বন প্রায় উজাড়, গাছচোরদের দাপটে ন্যাড়া পাহাড় থেকে জীবন রক্ষার তাগিদে পালিয়ে বেঁচেছে বন্য প্রাণীরা। তবে কাঠ পাচারকারীদের হাতে যেমন উজাড় হয়েছে বন, তেমনি চোরাশিকারিদের হাতেও প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য বন্য প্রাণী। চোখের সামনে তাদের গ্রামের আশপাশের সব বন দিনে দিনে প্রায় ধ্বংসের শেষপ্রান্তে, এই অবস্থা গ্রামের কারোরই ভালো লাগছিল না। গ্রামের বৃদ্ধ-তরুণ সবাই কিছু একটা করার তীব্র তাগিদ অনুভব করছিল—চোখের সামনে এভাবে তাদের প্রিয় গ্রাম, তাদের নিত্য বিচরণভূমি ওই বনাঞ্চল, বনাঞ্চলের পশুপাখি নিঃশেষ হয়ে যাবে, তা মেনে নেওয়া যায় না।

গ্রামের আনোয়ার কামালসহ বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে এ সময় যোগাযোগ ঘটল নিসর্গ নেটওয়ার্কের। তাদের সাহায্য-পরামর্শ নিয়েই চুনতির তরুণেরা গঠন করে বন সংরক্ষণবিষয়ক সহব্যবস্থাপনা কমিটি। এর সভাপতি করা হলো একসময়কার বিখ্যাত বন্য প্রাণী শিকারি আমিন খানকে। এই পর্যায়ে এসে যা সবাইকে আপ্লুত করল—শুধু পুরুষ নয়, চুনতির মেয়েরাও এগিয়ে এল বন রক্ষার আন্দোলনে।

তবে বন থেকে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করতে গিয়েও যে তারা বনটিকেই ধ্বংস করে ফেলছে, এটা শুরুতে অনেকে মানতে চায়নি। তারা এই উদ্যোগের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে সন্দেহ করে দূরে সরে থাকে অনেকেই। তবে এতে হতোদ্যম না হয়ে তরুণেরা নিরন্তর গ্রামবাসীকে বোঝাতে থাকে, বন ধ্বংস হলে তাদের ধ্বংসও অনিবার্য। তাই তারা বনটি দুই ভাগে ভাগ করল। একটি অংশকে করা হলো কোর জোন, যা থেকে কোনোভাবেই কোনো কাঠ ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা যাবে না। আরেকটি অংশকে করা হলো বাফার জোন, যেখানে গাছ বড় হলে কাটা যাবে এবং সহব্যবস্থাপনা কমিটির স্বেচ্ছাসেবকেরা ওই গাছের একটি অংশ পাবে। এভাবে গ্রামবাসীকে বন সংরক্ষক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অংশীদারি দেওয়া হলো। যারা কাঠ চুরির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদেরও স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য করা হলো।

বনের সংরক্ষিত এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছিলেন চারটি ইটভাটা। গ্রামবাসী সম্মিলিতভাবে অনেক চেষ্টার পর তিনটি ইটভাটাই উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়। বন বিভাগের কাছ থেকে সহব্যবস্থাপনা কমিটি ২০০৫ সালে ৮১৬টি গর্জন মাতৃগাছ বুঝে নেয়। ২০১২ সালে এসে মাত্র দুটি গাছ ধ্বংস হয়েছে। একটি বজ্রপাতে ভেঙে পড়েছে, আরেকটি কাঠচোররা কেটে নিয়ে পালানোর সময় সহব্যবস্থাপনা কমিটির হাতে ধরা পড়ে। চুনতির মানুষের অতন্দ্র প্রহরায় ৮১৪টি গাছ সগৌরবে মাথা উঁচু করে টিকে আছে।

বিশালকায় গর্জন মাতৃগাছ ছাড়াও চুনতি বনের ৭৩ বর্গকিলোমিটার সীমানার মধ্যে এক হাজার ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ আর ৪৫ প্রজাতির উঁচু গাছ রয়েছে। ১৮৭ প্রজাতির বন্য প্রাণীর বিচরণ ছিল চুনতির বনবাদাড়ে। তবে ২০০৫ সালের আগে এদের বেশির ভাগই বন ছেড়ে পালিয়েছিল কিংবা শিকারির হাতে ধরা পড়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। কয়েক বছর ধরে প্রাণীরা আবার বনে ফিরতে শুরু করেছে। বুনো হাতির আনাগোনাও বেড়েছে। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ আর ঝরনার পানির লোভে অন্য বন থেকে এখানে প্রাণীদের দল আসতে শুরু করেছে। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে বন আগের চেহারা ফিরে পাওয়ায়।

বিশ্বসম্মান
রিও শহরে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন চলাকালীন ২০ জুন ইকুয়েটর পুরস্কার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানস্থল ব্রাজিলের ভিভো রিও সম্মেলনকেন্দ্র সেই দিন ছিল লোকে-লোকারণ্য। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ওই অনুষ্ঠানের ঘোষণাসহ বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়। আগত হাজার দুয়েক দর্শকের সারিতে ছিলেন বিশ্বের ২০টি দেশের মন্ত্রীরা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান প্রশাসক হেলেন ক্লার্ক। সেখানে গিটার বাজিয়ে শোনান ব্রাজিলের সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী গিলবার্টো গিল। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচির (ইউএনইপি) নির্বাহী পরিচালক আচিম স্টেইনার অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও করেন। তবে সবার মধ্যমণি ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ওই অনুষ্ঠানে ১০টি দেশকে বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য যে পুরস্কার দেওয়া হয়, তা তুলে দেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ।
পুরস্কার পাওয়া অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ইথিওপিয়া, মরক্কো, গুয়াতেমালা, মাদাগাস্কার, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, মেক্সিকো, সেনেগাল, চীন, কেনিয়া, মিসর, মার্শাল আইল্যান্ড, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ফিজি, সোয়াজিল্যান্ড, জাম্বিয়া, টোগো, তাজিকিস্তান, কলম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও সুদান।

এ ছাড়া ১০টি থিমেটিক এরিয়ায় ১০টি দেশকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। সম্প্রদায়ভিত্তিক অভিযোজনে মার্শাল আইল্যান্ড, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ব্রাজিল, শুষ্ক ভূমি ব্যবস্থাপনায় ইথিওপিয়া, খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় তাজিকিস্তান, টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় মিসর, পানি ব্যবস্থাপনায় ভারত, উপকূলীয় বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনায় লাইবেরিয়া, সমুদ্র উপকূল ব্যবস্থাপনায় ইন্দোনেশিয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কলম্বিয়া ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সোয়াজিল্যান্ডকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

আমরা বন রক্ষা করি, বন আমাদের রক্ষা করে
শাড়ি পড়া সারি সারি নারী প্রহরী। সকাল থেকে সন্ধা অবধি যে যখন সময় পায়, দেয় বন প্রহরা। চুনতি বন থেকে কোন গাছ তারা কাটতে দেবেনা তারা। মারতে দেবেনা কোন বণ্যপ্রাণী। বন রক্ষাই যেন তাদের পন।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবনে ঘটে যাওয়া পাহাড় ধসের ঘটনায় শতাধিক প্রাণহানী ঘটেছে। কিন্তু চুনতি এলাকায় ভারি বৃষ্টি হলেও সেখানে কোন ভূমি ধসের ঘটনা ঘটেনি। এর কারন ব্যখ্যা করতে গিয়ে চুনতি অভয়ারন্য সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য শামিমা আখতার গর্ব করে বলে উঠেন ‘আমরা বন রক্ষা করি, বন আমাদের রক্ষা করে।’

চুনতি বন এলাকার ভূমির গঠন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্য এলাকাগুলোর মতো এখানে বর্ষায় ভারি বৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রচন্ড বর্ষন আর পাহাড়ি ঢল বনের গাছ পালায় বাধা পায়। বনটির নিচে বালি মাটির স্তর থাকলেও সেখানে ভূমিধসের ঘটনাও কম ঘটে। বনের গাছ-পালা ও লতাগুল্ম মাটিকে ধরে রাখে।

আর চুনতি বনের গাছপালা আর প্রাণীদের রক্ষায় গড়ে উঠা সহ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও বন প্রহরিদের মধ্যে ৭০ জনই নারী। সকালে সবুজ শাড়ি পড়ে নারী প্রহরীরা যখন বনের ভেতর দিয়ে হেটে যায় তখন দুই সবুজে মিলে যেন একটি মায়াবি জগৎ তৈরি হয়। বন প্রহরি ফাতেমা বেগম যেমনটা বলেন, ‘চুনতি বন আর সংসার দুইটাই আমার কাছে সম্পদ। সম্পদকে তো আর চোর ডাকাতের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়না।’

তারিখ: ২৯-০৬-২০১২