‘শুরুটা হয়েছিল পরিবার আর চারপাশের মানুষের কথা ভেবেই। দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় যখন সবজি ও ফলমূল খেতেই হয়, তখন তা কতটা নিরাপদ? ক্ষতিকর কীটনাশক আর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার মানুষের শরীরের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। এসব থেকে বাঁচতেই ভিন্নধর্মী এ চিন্তা মাথায় আসে আমার। ব্যস, এর পরই কাজ শুরু করলাম।’ এভাবেই আলাপের শুরু ফ্রেশ অ্যান্ড সেফ এগ্রো লিমিটেডের (ফসল) চেয়ারম্যান শারমিন হোসাইনের সঙ্গে। বলার মতো এমনই কঠিন কাজ শারমিন হোসাইন সহজ করে নিয়েছেন নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে। তিনি ক্ষতিকর কীটনাশক আর রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদিত সবজি ও ফলমূল পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রাহকের কাছে। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এই দুর্লভ কাজ? উত্তরে শারমিন হোসাইন বলেন, ‘আমরা ঢাকার বাইরে মানিকগঞ্জ, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গাসহ বেশ কিছু জেলা বেছে নিয়েছি, যাতে কম সময়ে ঢাকায় পণ্য পৌঁছানো যায়। সেখানে নির্বাচিত কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আমাদের এরিয়া ম্যানেজারদের দিয়ে। এরপর পণ্য উৎপাদনের সময় সার, মাটি, বীজ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত বুঝিয়ে ফসল উৎপাদন করা হয়। পোকার আক্রমণ ঠেকাতে আমরা নিজেদের উৎপাদিত নিমের নির্যাস, শসাপাতার নির্যাস, ফেরোমনট্রাব ইত্যাদি বিনা মূল্যে সরবরাহ করি। আমাদের কর্মীরা তা নিয়মিত মনিটরিং করেন। ফসল পরিপক্ব হলে মাঠ থেকে তোলার তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছানো হয়। তারপর এসব পণ্য শোধন করে আমাদের নির্ধারিত আউটলেট থেকে বিক্রি করা হয়।’ ব্যবসাটা কৃষি নিয়ে হওয়ায় সাহস করে নেমে পড়েন শারমিন হোসাইন। কারণ, নিজের লেখাপড়ার বিষয়ও ছিল কৃষি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। এরপর স্বামী বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি আবু মুসা মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম খানের চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোরেন। অবশেষে ঢাকায় এসে থিতু হন ২০০০ সালে। এর মধ্যে চার মেয়ে আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। মেয়েরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দিকে তাকানোর সময় মেলতে শুরু করে শারমিনের। এরপর নিজের মাথায় আসা এই ধারণা নিয়ে যখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন সবাই উৎসাহ দেন। এরপর মাঠপর্যায়ে গবেষণা আর কৃষকদের সঙ্গে আলাপে সময় যায় আরও তিন বছর। কারণ, শারমিন মনে করেন, কোনো কাজ পরিকল্পনা করে এবং জেনে-বুঝে করা ভালো। পরীক্ষা বা গবেষণার কাজে তিনি মানিকগঞ্জে নিজেদের কিছু জমি ব্যবহার করেন। ২০১০ সালে ফসল যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মানিক মিয়া এভিনিউ ও বনানীতে রয়েছে ফসলের আটটি শাখা, যেখানে ১২ মাস পাওয়া যায় মৌসুমি সবজি, আম, কলা, পেঁপে, ডিম, ঢেঁকিছাঁটা চাল, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস, মধু, দুধ ইত্যাদি। এরই মধ্যে গুণগত মানের কারণে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফসল। নির্ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করায় শারমিন হোসাইন এ বছর পেয়েছেন ‘ডিএইচএল-দ্য ডেইলি স্টার বিজনেস অ্যাওয়ার্ড-২০১২’। পুরস্কারের অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যাত্রা শুরুর মাত্র দুই বছরের মধ্যে এমন সম্মান আমাকে আরও সচেতন করল। সৎভাবে ব্যবসা করলে তার মূল্যায়ন হবেই। আর নারীরা শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এমন নানা ধরনের পেশায় অবদান রাখতে পারেন।’ নতুন ধরনের ব্যবসা, তাই ব্যাংকঋণ পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে তাঁর। ‘তবে বন্ধুরা এবং সাইগ্রাস ফিন্যান্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান রোকেয়া আফজাল রহমানের ঋণ আমাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়।’ বলেন তিনি। পাবনার চাটমোহরে ফসল এবংক্যাটালিপ্টের যৌথ আয়োজনে বাড়ির আঙিনায় সবজি উৎপাদন নামের প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার ৮৭৫ জন নারীকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ। দুই বছর আগের রুটিনের মতো ঘর আর বাচ্চাদের দেখাশোনা ঠিকই করছেন। সকালে স্বামীর অফিসে যাওয়া, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া এবং শাশুড়ির ওষুধ খাওয়ানো—সব সামলে শ্যামলীতে নিজের অফিসে যাওয়া; সেখান থেকে গাবতলীর ঢাকা সেন্ট্রাল মার্কেটে। এখান থেকেই সব মালামাল ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুমুক্ত করে পাঠানো হয় বিক্রয়কেন্দ্রে। নিজেই খোঁজ নেন কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে। এর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ, বিক্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন—সবই চলে। এত কিছুর পরও মুখে মধুর হাসি শারমিন হোসাইনের। কারণ, তাঁর মতে, ‘নিজের জ্ঞান ব্যবহার করে আমি তো মানুষের সেবাই করতে চাই।’