জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রশিক্ষণে ২৫ বছরে স্বাবলম্বী তিন লাখ নারী

আইনগতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পর গত ২৫ বছরে প্রায় তিন লাখ নারীকে স্বাবলম্বী হতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছে জাতীয় মহিলা সংস্থা। বর্তমানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত এই সংস্থা আত্মকর্মসংস্থানে এখন পর্যন্ত ৪১ হাজার ৪২৮ নারীকে ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬ টাকা ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সহায়তা করেছে। এছাড়া প্রায় আট লাখ নারীকে যৌতুক ও বাল্যবিবাহ, নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ বিষয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতন করা হয়েছে। তবে গত ২৫ বছর ধরেই দেশের ৬৪টি জেলা শহর ও ৫০টি উপজেলার নারীরাই শুধু সংস্থার কার্যক্রমের আওতায় আসতে পারছেন। বাকি ৪৩২টি উপজেলার নারীরা এর কার্যক্রমের বাইরে রয়েছেন।
এ বিষয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জাহানারা পারভীন সকালের খবরকে বলেন, ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়নের মূলধারায় নারীদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। বর্তমানে সংস্থার নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি চারটি প্রকল্প এবং তিনটি কর্মসূচির মাধ্যমে ৬৪ জেলা ও ৫০ উপজেলা শাখার মাধ্যমে নারীদের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় সংস্থার শাখা স্থাপন করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। এ প্রস্তাব বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন আছে। আশা করছি তারা আমাদের প্রস্তাব মেনে নেবে। তাহলে শিগগিরই বেশ কিছু উপজেলায় সংস্থার শাখা স্থাপন করা সম্ভব হবে।
সংস্থার লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য সচিব শহীদুল ইসলাম নিজামী বলেন, প্রস্তাব অনুযায়ী বাকি ৪৩২টির মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১৫০ উপজেলায় শাখা স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সংস্থায় বর্তমানে দক্ষ জনবলের সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া নিজস্ব কোনো আইনজীবী নেই। নারী নির্যাতন সেলের মামলা নিষ্পত্তির জন্য বাইরে থেকে আইনজীবী আনতে হয়। জরুরি ভিত্তিতে একজন কম্পিউটার অপারেটর, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া দরকার। এছাড়া প্রায় ৫০ জন ট্রেড সহকারী ও বয়স্ক শিক্ষা প্রশিক্ষক থাকলেও সাংগঠনিক কাঠামোতে তারা অন্তর্ভুক্ত নেই। এসব সমস্যা
সমাধানে সাংগঠনিক কাঠামো ও চাকরি বিধি সংশোধন করা প্রয়োজন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সংস্থার কার্যক্রমকে অধিকতর ফলপ্রসূ ও জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের ৪ মে জাতীয় মহিলা সংস্থা আইন করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে এই সংস্থা একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়।
শহীদুল ইসলাম নিজামী জানান, সংস্থার নিয়মিত কাজের আওতায় ১৯৯৬ সাল থেকে বছরে প্রায় ১০ হাজার জন করে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার অনগ্রসর, অবহেলিত ও বেকার নারীকে দর্জিবিজ্ঞান, এমব্রয়ডারি, ব্লক-বাটিক, চামড়াজাত শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ১৯৯৮ সাল থেকে স্বকর্ম সহায়ক ঋণ কার্যক্রমে মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ১৯৫ নারীকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। নির্যাতিত অসহায় নারীদের ১৯৯৬ সাল থেকে সংস্থার নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিনা খরচে ২০১১ সালের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ২৮১ জন নির্যাতিত নারীকে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এই ভুক্তভোগী নারীদের খোরপোষ বাবদ মোট ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত এক বছরে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ১৬৩ নারী। খোরপোষ বাবদ এই ভুক্তভোগী নারীদের আদায় করে দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার টাকা।
সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৭২ হাজারের বেশি নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
সংস্থার বর্তমানে চলমান চারটি প্রকল্প সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহর অঞ্চলের দরিদ্র, বেকার, বিত্তহীন প্রান্তিক নারীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমানে নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) চালু রয়েছে। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭২ হাজার ৭০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ এবং আত্মকর্মসংস্থান ও স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করা হবে। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ে ২০০৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ২৬টি জেলায় ৪৬টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে সেলাই, পোল্ট্রি উন্নয়ন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরি, হাউস কিপিংসহ ১০টি ট্রেডে ২৫ হাজার ৭২০ জন প্রান্তিক নারীকে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এদিকে দেশের শিক্ষিত ২৫ হাজার ৬০০ নারীকে কম্পিউটার ও তথ্য যোগাযোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প (৬৪ জেলা) মহিলা সংস্থার অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর একনেকে অনুমোদনের পর এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ১৪৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।
বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের ৩৩টি উপজেলায় ২২ হাজার ৫০০ নারী উদ্যোক্তাকে ব্যবস্থাপনা ও পেশাগত দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং ৬০ হাজার জনকে বিভিন্ন ট্রেডে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প। গত বছরের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২০ সালের জুনে শেষ হবে। এই প্রকল্পের আওতায় নারী উদ্যোক্তারা হাঁস-মুরগি পালন, বিউটি পার্লার, ডিজাইন, বুটিকসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি বাজারজাতকরণের জন্য বিভিন্ন বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র তৈরি করা হবে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে নেওয়া অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম পর্যায়ে প্রায় ২৫০ জন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ২১০০ জন নারী উদ্যোক্তা সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করছে। এছাড়া এই দুই পর্যায়ে আরও প্রায় ১৮ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তথ্য আপা : ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২ লাখ ৪৩ হাজার ২৫ জন নারীকে তথ্যসেবা দিয়েছে। এছাড়া উঠান বৈঠকের মাধ্যমে ২৫ হাজার ৩২৩ সেবাগ্রহীতাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য, আইনগত সমস্যা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
সংস্থার সামাজিক নিরাপত্তামূলক তিনটি কর্মসূচির মধ্যে মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার ২৩৩ নারীর মাঝে ৩৭ কোটি ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ থেকে ইতোমধ্যে আদায় করা হয়েছে ২৪ কোটি ৫২ লাখ ২৭ হাজার ১৮৩ টাকা। শতকরা হিসেবে ঋণ আদায়ের হার ৬০ ভাগ।
বিশেষায়িত আধুনিক ট্রেড প্রশিক্ষণ কর্মসূচির (খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিউটিফিকেশন) আওতায় আড়াই বছরে ২১ হাজার ৬০০ নারীকে দুটি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৮ হাজার ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে এই কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাকি ৩ হাজার ৫৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দেশের ৩০টি জেলায় এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আর ক্যাটারিং (খাদ্য প্রস্তুতকরণ, সংরক্ষণ ও সার্ভিসিং) প্রশিক্ষণ, জেলা পর্যায়ে কর্মসূচির মাধ্যমে তিন বছরে ৩৪টি জেলার ১২ হাজার ২৪০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত এই কর্মসূচির মেয়াদ। ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৮৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সংস্থার পরিচালনায় ইতোমধ্যে সমাপ্ত হওয়া গ্রামীণ মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প এবং মহিলা উদ্যোক্তা প্রকল্প দুটির মাধ্যমেও বেশ কয়েক হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কর্মজীবী নারীদের জন্য সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে ‘শহীদ আইভী রহমান কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল’ নামে একটি হোস্টেল এবং কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে।