চট্টগ্রামের হাতিরঝিলে…

পাশে বয়ে চলছে কর্ণফুলী নদী। মৃদু-মন্দ হাওয়া শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় শরীর-মনে। সাম্পান থেকে শুরু করে লাইটারেজ জাহাজ—কী নেই নদীর বুকে। আবার পুব দিকে তাকালেই চোখে পড়ে দর্শনীয় শাহ আমানত সেতু। পড়ন্ত বিকেলে বিদায় নেওয়ার আগমুহূর্তে সূর্য রাঙিয়ে দিয়ে যায় পশ্চিমের আকাশকে।

এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে সবাই এখন ছুটে যাচ্ছেন নগরের অভয় মিত্র ঘাট এলাকায়। নদীর পাড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে খোলা জায়গা। বিশুদ্ধ বাতাস আর নদীর সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন বিকেলে এখানে ছুটে আসেন শত শত নগরবাসী। তাঁদের কেউ নদীর পাড়ে বসে আড্ডা দেন, কেউবা মগ্ন থাকেন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে, আবার কেউ কেউ কর্ণফুলী নদীর বুকে বেড়ানোর জন্য নৌকায় উঠে পড়েন। দর্শনার্থীদের ভিড়ে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে নগরের এই এলাকা। বছর তিনেক ধরে এভাবেই নগরবাসীর ঘুরে বেড়ানোর নতুন জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভয় মিত্র ঘাট এলাকা।

চট্টগ্রামের হাতিরঝিল: ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী নদীর খননকাজ শুরু করে। কিন্তু পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগেই ২০১৩ সালের আগস্টে এসে খনন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই সময়ে নদী থেকে উত্তোলন করা বালু ও মাটি প্রকল্প এলাকায় রাখা হয়। ভরাট করা জায়গায় গড়ে তোলা হয় সুদৃশ্য সেতু, সড়ক ও স্থাপনা। ধীরে ধীরে এই স্থান হয়ে ওঠে নগরবাসীর ঘুরে বেড়ানোর নতুন স্পট।

জানা গেছে, যেখানে বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট হয়েছে সে জায়গায় সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। মূলত নগরবাসীর ঘুরে বেড়ানোর উপযোগী করে তোলার জন্য এ পদক্ষেপ নেয় বন্দর। এর অংশ হিসেবে ঠিকাদারদের দিয়ে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালে দৃষ্টিনন্দন তিনটি ইস্পাতের সেতু স্থাপন করা হয়। ঢাকার হাতিরঝিলে স্থাপন করা সেতুর সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এসব সেতুর। ফলে ভ্রমণপিয়াসীরা জায়গাটিকে চট্টগ্রামের হাতিরঝিল হিসেবে ডাকতে শুরু করেন।

গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, অভয় মিত্র ঘাটে হাজারো পর্যটকের ভিড়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ ভিড় বেড়েই চলছিল। সন্ধ্যা হতেই বিশাল এলাকায় কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দর্শনার্থীদের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে ঘাট এলাকা।

নগরের বাকলিয়া থেকে ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে আসেন ব্যাংক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘অভয় মিত্র ঘাটের পাল্টে যাওয়ার কথা বন্ধুবান্ধবের মুখে অনেক শুনেছি। এবার ঈদের টানা ছুটিতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে চলে এলাম। ভালোই লাগছে নতুন পরিবেশ দেখে।’

অপরিকল্পিত দোকানপাট: দর্শনার্থীদের উপস্থিতি দিন দিন যতই বাড়ছে, একই হারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দোকানের সংখ্যা। অপরিকল্পিতভাবে দোকান স্থাপনের ফলে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে উন্মুক্ত স্থান। গত শুক্রবার দেখা যায়, অভয় মিত্র ঘাট এলাকায় নদীর ধারে গড়ে উঠেছে চটপটি-ফুচকা, কাঁকড়া, চিপস, আইসক্রিমসহ বিভিন্ন দোকান।

এই এলাকায় প্রায় নিয়মিত ঘুরতে আসেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এখানে অনেক দোকান গড়ে উঠেছে। দোকানগুলোর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা হয়। এতে আগের যে পরিবেশ ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ উন্মুক্ত স্থানে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার জন্য এই এলাকায় আসতেন, কিন্তু কোনো নজরদারি না থাকায় সে অবস্থা নেই। তিনি বলেন, নগরে এমনিতেই উন্মুক্ত স্থানের অভাব রয়েছে। তাই এ জায়গাটি যাতে উন্মুক্ত থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

স্কুলশিক্ষক কাজী মাহতাব করিম বলেন, ‘নদীর ধারে উন্মুক্ত স্থান—শুধু এই কারণে এখানে ছুটে আসতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। কিন্তু এখন উন্মুক্ত স্থানে অপরিকল্পিতভাবে দোকান গড়ে উঠেছে। পাথরের যেসব ব্লকে বসে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতাম, সেগুলো এখন দোকানিরা দখল করে ফেলেছেন। ফলে বসার জায়গাও কমে গেছে। এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের উৎপাত তো আছেই।’

চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সদস্য জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের অনুমোদন ছাড়াই দোকানগুলো স্থাপন করা হয়েছে। প্রয়োজনের নিরিখে হয়তো সেগুলো গড়ে উঠেছে। তবে এসব দোকান সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। আর পুরো জায়গাটি উন্মুক্ত রাখা হবে। যাতে নগরবাসী ঘুরে বেড়াতে পারেন।

জাদুঘর আর স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা: দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে অভয় মিত্র ঘাট এলাকাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা নিচ্ছে বন্দর। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এরপরই শুরু হবে বাস্তবায়নের কাজ।

চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সদস্য জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকাকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে বন্দরের বড় একটা পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে অ্যাম্ফি থিয়েটার, স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর বন্দর ও স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তি করে একটি জাদুঘর করা হবে। এই পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন করতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে।